ইতালীতে অযত্নে-অবহেলায় শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমাধি

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১১, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১৮ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:১৮ অপরাহ্ণ

রোম: আজ ১০ই জানুয়ারি। বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালামের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের এই দিনে ইতালীর রাজধানী রোমে এক নির্জন এপার্টমেন্টে জীবনাবসান ঘটে প্রচণ্ড আত্ম-অভিমানী এই মেধাবী বাঙালির। ১৯৫৯ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন তিনি ইতালীতে।

দেশটির ‘প্রথম বাংলাদেশী’ শামসুদ্দীন আবুল কালামের জন্ম ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের বরিশালে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইতালী থেকেই ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে।

১৯৫৯ থেকে ১৯৯৭ ইতালীতে সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের প্রবাস জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করলেও দেশটির কর্মক্ষেত্রে ছিল তার সফল পদচারণা।

সত্তরের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম কর্মরত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থ (ফাও)-এর রোমস্থ সদর দফতরে এবং ইতালিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে। ইতালীয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ছিল তার পদচারণা। ইতালীতে আসার আগেই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের বেশ কটি বিখ্যাত উপন্যাস।

বিখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের সবচাইতে সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘কাশবনের কন্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। পরবর্তীতে পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাতে আসে উপন্যাস – দুই মহল (১৯৫৫), কাঞ্চনমালা (১৯৫৬), জীবন কাণ্ড (১৯৫৬), জাইজঙ্গল (১৯৭৮), মনের মতো স্থান (১৯৮৫), সমুদ্রবাসর (১৯৮৬), যার সাথে যার (১৯৮৬), নবান্ন (১৯৮৭) ও কাঞ্চনগ্রাম (১৯৮৭)।

ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প সংগ্রহ ‘অনেক দিনের আশা’। পরের বছর ‘ঢেউ’ ও ‘পথ জানা নেই’। দুই হৃদয়ের তীর (১৯৫৫) এবং সাহের বানু (১৯৫৭) এই বাঙালি গুণীজনেরই অমর সৃষ্টি।

১৯৫৯ সালে ইতালী পাড়ি জমাবার আগে সংসার জীবনে অবশ্য সুখী হতে পারেননি শামসুদ্দীন আবুল কালাম। কন্যা ক্যামেলিয়ার জন্মের পর স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেলে পরে ওই ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মোস্তফা। নতুন সংসার আলো করে আসে সুবর্ণা, যিনি পরবর্তিতে বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সুবর্ণা মোস্তফা নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সৎবোন ক্যামেলিয়া মোস্তফা কিছুদিন অভিনয় জগতে থাকলেও এক পর্যায়ে পাড়ি জমান বিদেশ বিভুঁইয়ে, বাবার পথ ধরে। তবে ইতালীতে আসেননি ক্যামেলিয়া, নিউইয়র্কের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ নেন জীবিকার তাগিদে।

১৯৯৭ সালে শামসুদ্দীন আবুল কালামের মৃত্যুর সময় নিউইয়র্কেই অবস্থান করছিলেন ক্যামেলিয়া মোস্তফা। বৈধ স্টে পারমিট না থাকার কারণে আমেরিকা থেকে বের হতে পারেননি তখন তিনি। অবশ্য মৃত্যুর পরপরই বাবার একাউন্টে থাকা প্রায় ১২ হাজার ডলারের সমপরিমাণ ইতালীয়ান লিরা আমেরিকাতে বসেই দ্রুত বুঝে নেন ক্যামেলিয়া। বেশ কয়েক বছর পর ক্যামেলিয়া বাংলাদেশ ফিরে গেলেও ইতালীতে বাবার সমাধি এক নজর দেখতে আসার প্রয়োজন মনে করেননি। তার উদাসীনতার কারণেই মূলত শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমাধি বিগত বছরগুলোতে রোমের খ্রিস্টান গোরস্থান থেকে পাশেই মুসলিম গোরস্থানে স্থানান্তরিত হয়নি।

সত্তর ও আশির দশকে ইতালীতে ছিল খুব স্বল্প সংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস। নব্বইর দশকে দেশটিতে বাংলাদেশীদের আগমন দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও স্বদেশীদের সঙ্গে খুব একটা মেশা হয়ে ওঠেনি তার। বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আরেক প্রবীণ বাংলাদেশী লুৎফর রহমান যিনি এখনও জীবিত আছেন, মূলত তার সাথেই কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হতো শামসুদ্দীন আবুল কালামের। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আত্ম-অভিমানী এই কথাসাহিত্যিক জীবনের শেষ দিনগুলোতে এতোটাই জীবনবিমূখ হয়ে উঠেছিলেন যে, ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্বেও বাজার করতেন না এবং অনেকটা না খেয়েই ধীরে ধীরে ধাবিত হন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।

শামসুদ্দীন আবুল কালামের দুঃখজনক মৃত্যুর সময় ১৯৯৭ সালে এই প্রতিবেদক রোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের পাশাপাশি ওই সময়কার ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের ইতালী প্রতিনিধির দায়িত্বে থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেননি কিছুই। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমানসহ সবাই জানতে পারেন রোমে তাকে সমাহিত করার বেশ কিছুদিন পর ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে লন্ডনের বিশেষ সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে। পরে জানা যায়, শামসুদ্দীন আবুল কালাম তার নির্জন এপার্টমেন্টে মারা যাবার বেশ অনেক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল বহুতল ভবনের বাইরে থেকে জানালা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে।

শামসুদ্দীন আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধারের পর ডকুমেন্টে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় পরিচয় না থাকায় এবং আত্মীয় বা নিকটজন কারো কোনো সন্ধান পুলিশ না পেয়ে মূলত ‘বেওয়ারিশ’ লাশ হিসেবে তাকে রোমের এক প্রান্তে ‘প্রিমাপর্তা’ এরিয়াতে জানাজা ছাড়াই খ্রিস্টান গোরস্থানে সমাহিত করে।

পাশেই মুসলিম গোরস্থান থাকলেও ‘রক্ত-সম্পর্কীয়’ নিকটজনের অনুমতি না পাওয়ায় আজো স্থানান্তর করা হয়ে ওঠেনি বাংলার এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের সমাধি। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমান গত ১৮ বছর ধরে যখনই সময় পেয়েছেন ছুটে গেছেন ‘প্রিমাপর্তা’ সমাধিক্ষেত্রে, করেছেন পরিচর্চা। নিউ ইয়র্কে এবং ঢাকায় ক্যামেলিয়াকে এ বিষয়ে বহুবার জানানো হলেও জন্মদাতা পিতার সমাধি সঠিক স্থানে স্থানান্তরের সামান্য ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেবার তাগিদ অনুভব করেননি কন্যা। অসুস্থতা জণিত কারণে কয়েক বছর আগে ঢাকাতে ক্যামেলিয়াও চলে যান ‘না ফেরার দেশে’।

শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রতি ‘যারপরনাই’ উদাসীন রোমের বিশাল বাংলাদেশ কমিউনিটিও। বাংলাদেশ ভিত্তিক নোংরা রাজনীতি এবং ভিলেজ পলিটিক্স চর্চার ‘ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড’ খ্যাত এখানকার কমিউনিটি আজ অবধি ন্যূনতম সম্মান দেখায়নি ‘প্রিমাপর্তা’ সমাধিক্ষেত্রে শুয়ে থাকা বাংলার এই সোনার সন্তানের প্রতি। যে দূতাবাসে একদা তিনি কর্মরত ছিলেন, রোমের সেই বাংলাদেশ দূতাবাসেরও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই শামসুদ্দীন আবুল কালামের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোন উদ্যোগ নেবার।

আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আক্ষেপের সুরে একটাই অনুভূতি – আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশী, আলোর পেছনে আমাদের অন্ধকারই যে অনেক অনেক বেশি।

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G